রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০২ অপরাহ্ন
মীর তারেক বিন তাহের:
মানুষ মানবিক প্রাণী। একসঙ্গে একসমাজে বসবাস করতে হলে শ্রেণি-ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতে হয় সবার সঙ্গে। মানুষ হিসেবে আমাদের সবার পরিচয় এক। আমাদের পার্শ্ববর্তী কোনো মুসলিম অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া যেমন সুন্নত, একইসঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী কোনো অমুসলিম অসুস্থ হলে তাকেও দেখতে যাওয়া পুণ্যের কাজ। তাকে দেখতে যাওয়া ইসলাম শুধু বৈধতাই দেয়নি বরং ইসলাম উৎসাহ প্রদান করেছে।
অনেকে মনে করেন, তাদের দেখতে যাওয়া কিংবা সেবা-শুশ্রুষা করা যাবে না। এসব ধারণা নিতান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত ও ভুল। ইসলাম যেভাবে স্বধর্মের লোকদের নিরাপত্তা সম্পর্কে পূর্ণ সতর্ক, একইভাবে ভিন্ন ধর্মালম্বীদের প্রতিও উদার। তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া, বিভিন্ন সংকটে সাহায্য করা, অসুস্থায় সেবা-শুশ্রƒষা করার অনুমতি ইসলাম দেয় এবং পুণ্যের কাজ হিসেবে উৎসাহিত করে। এ সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।
অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষত রাখতে মহীয়ান রব পবিত্র কোরআন মাজিদে বর্ণনা করেন, ‘যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধরত নয় এবং মাতৃভূমি থেকে তোমাদের বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে দয়া ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না।’ -সুরা মুমতাহিনা : ৮
তিনি আরও বলেন, ‘তোমার (অমুসলিম) মাতা-পিতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মানবে না, তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে বসবাস করবে সদ্ভাবে।’ -সুরা লোকমান : ১৫
অমুসলিমদের সেবা-শুশ্রুষার বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত থেকে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ইহুদি যুবক রাসুল (সা.)-এর সেবা করত। একদা সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাসুল (সা.) তাকে দেখতে যান। তার মাথার কাছে বসে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে তার পিতার দিকে দৃষ্টি ফেরালে, তার পিতা বললেন, তুমি আবুল কাসিম (মুহাম্মদ সা.)-এর অনুসরণ করো। অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ করল। তিনি বললেন, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্য, যিনি এই যুবককে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। একথা বলতে বলতে বের হয়ে গেলেন।’ -সহিহ বোখারি
সর্বশ্রেণির মানুষের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে, ‘একদিন সাহল ইবনে হুনাইফ ও কায়েস ইবনে সাদ (রা.) কাদেসিয়াতে বসা ছিলেন। তখন তাদের পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে কিছু লোক অতিক্রম করল। তারা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদের বলা হলো, লাশটি অমুসলিমের। প্রত্যুত্তরে তারা বললেন, মহানবী (সা.)-এর পাশ দিয়ে একসময় একটি লাশ নেওয়া হয়েছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাকে বলা হলো, এটা তো এক ইহুদির লাশ। তখন তিনি বলেন, তা কি প্রাণ নয়?’ -সহিহ বোখারি : ১২৫০
এ হাদিসটিতে গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলছেন, ‘তা কি প্রাণ নয়।’ তিনি সদ্ব্যবহার ও সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে শ্রেণিবৈষম্যের গন্ডির বাইরে গিয়ে বললেন- ‘তা কি প্রাণ নয়।’ এখান থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। একজন মুসলিমের সঙ্গে যেভাবে আমরা আচরণ করব, ঠিক একইভাবে অমুসলিমদের সঙ্গেও উদারনীতি অবলম্বন করতে হবে।
হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, ‘রাসুলের যুগে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার কাছে এলেন। তখন আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মা এসেছেন, অথচ তিনি অমুসলিম। আমি কি তার আত্মীয়তা রক্ষা করব? নবী কারিম (সা.) বলেন, হ্যাঁ, তার সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করো।’ -সহিহ বোখারি : ২৪৭৭
তাছাড়া অমুসলিমদের কাছে ইসলামের সুমহান অনুপম আদর্শ তুলে ধরার এটি একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম। আমরা জানি, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহিন এবং নিষ্ঠাবান খলিফারা অমুসলিমদের সঙ্গে কত সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধায় পাশে থেকেছেন।
তাই আমাদেরও উচিত তাদের জীবন চরিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অমুসলিমদের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করা। তাদের সুবিধা-অসুবিধায় এগিয়ে যাওয়া। তাদের অসুস্থতায় সেবা-শুশ্রুষা করা। তাহলেই একটি সম্প্রীতির দেশ ও সমাজ গড়ে উঠবে।
ভয়েস/আআ